User: Kolkata Durga Puja Festival
Date posted: Fri, 11 May 2018 03:21:40 GMT
"সতীকথায়_সতীপীঠ"
৫১ শক্তিপীঠ দর্শন
#KolkataDurgaPujaFestival
~ পর্ব ৩১ ~...
দেবী - জয়ন্তী
শক্তিপীঠের নাম - জয়ন্তীয়া
জয়ন্তী পীঠ ঠিক কোথায়- তা নিয়ে পণ্ডিত দের বিতর্ক আছে । উইকিপিডিয়া ও কিছু প্রাচীন শাস্ত্র বাংলাদেশের শ্রীহট্টে এই পীঠ বলে চিহ্নিত করেছেন । অপরদিকে কিছু শাস্ত্রের মত পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে আলিপুরদুয়ার সংলগ্ন ভূটান পাহাড়ের এক গুহায় এই পীঠ অবস্থিত বলে বর্ণনা করেছেন । দুই পীঠের নাম জয়ন্তী । তবে ঐতিহাসিক বিচারে বর্তমান বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার কালজোর বাউরভোগ গ্রামে এই পীঠ অবস্থিত বলে মনে করা হয় । জয়ন্তী পীঠে দেবী সতীর বাম জঙ্ঘা পতিত হয় ( মতান্তরে পৃষ্ঠদেশের অংশ )। দেবীর নাম জয়ন্তী আর ভৈরব হলেন ক্রমদীশ্বর । এই দেবী পীঠ সম্বন্ধে বলা হয়-
জয়ন্ত্যাঁ বামজঙ্ঘা চ জয়ন্তী ক্রমদীশ্বরঃ ।
ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে লেখেছেন-
জয়ন্তায় বামজঙ্ঘা ফেলিল কেশব ।
জয়ন্তী দেবতা ক্রমদীশ্বর ভৈরব ।।
এই পীঠ আবিস্কারের সাথে আশ্চর্যজনক এক কাহানী জড়িয়ে আছে । সময় টা ১৫৪৮-১৬৬৪ সাল । তখন জয়ন্তীতে রাজত্ব করতেন রাজা বড়গোসাঞি । একদা বসন্ত কালীন ঘটনা। প্রকৃতি ফুলে ফলে সেজে আছে । গ্রামের একদল কিশোরী একদল রাখাল বালক এর সাথে খেলছিল। তারা সেখানে একটি কালো পাথর দেখলো। তাঁদের মনে পূজা পূজা খেলার ইচ্ছা জাগল । যেমন শিশুরা মাটির মূর্তি বা মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজো পূজো খেলে ঠিক তেমনি। গাছে ফুল ফলের অভাব নেই। বালক বালিকারা কালো পাথর টিকে মা কালী ধরে নিয়ে, বনের ফুল তুলে পূজো করে কলা পাতায় বনের ফল নিবেদন করলো। মাটির ভাড়ে ঝর্নার জল নিবেদন করলো । কিন্তু কালী পূজোয় তো বলির দরকার। একজন বালক কে পাঠা সাজালো। সেই বালক পাঠার মতো ম্যাঁ ম্যাঁ করতে লাগলো । একজন শোলা দিয়ে খড়গ বানালো। সেই শোলার খড়্গের আঘাতে সেই পাঠা সেজেছিল যে বালক- তার মুণ্ড চ্ছেদ হয়ে গেলো। শোলার খড়্গে মুণ্ডচ্ছেদ দেখে ভয়ে বালক বালিকারা পালালো। কারন শোলা সামান্য হালকা পাতলা, ধারালো না। এতে মুণ্ডচ্ছেদ দেখে সকলে ভয় পেয়েছিল । শেষে সেই বালকের মা এসে সেই পাথরের সামনে অনেক অনুনয় বিনয় প্রার্থনা করতেই দেখা গেলো সেই নিহত বালক হাসতে হাসতে বন থেকে বেরিয়ে আসছে । এই অলৌকিক খবড় রাজার কানে গেলো ।
রাজা তার গুরুদেব কে নিয়ে সেই স্থানে গেলো । সেই গুরু ছিলেন একজন তান্ত্রিক আচার্য । গুরুদেব ধ্যানে বসলেন। ধ্যান সমাপ্তে জানালেন – “হে রাজন। এই স্থান মহা পবিত্র। ভগবান হরির চক্রে খন্ডিত হয়ে মা সতী দেবীর বাম জঙ্ঘা এই স্থানে পতিত হয়েছে । তুমি মায়ের নিত্য পূজোর ব্যবস্থা করো।” রাজা ভাবলেন পাথর টিকে রাজবাড়ী নিয়ে গিয়ে নিত্য পূজো দেবেন । কিন্তু তুলতে বিফল হলেন। অনেক গর্ত খুঁড়েও পাথরের তল পেলেন না। গুরুদেব নির্দেশ দিলেন- এখানেই মন্দির বানিয়ে পূজোর ব্যবস্থা করো । রাজা মন্দির বানিয়ে নিত্য পূজোর ব্যবস্থা করলেন ।
দেবীর মন্দিরের বলতে জানা যায়- চারকোণা অগভীর গর্তের মধ্যে একটি চৌকো পাথরের মধ্যে দেবীর পীঠ। অনেকের মতে দেবী জয়ন্তী তাঁর ভৈরব ক্রমদীশ্বরের সাথে এই কুণ্ডে বিরাজ করেন । মন্দিরের অনতিদূরে আর একটি কুণ্ড আছে। এখানে জল অল্প হলেও স্বচ্ছ। এই জল দিয়ে দেবীর পূজো হয় । মন্দিরের থেকে অল্প দূরে আর একটি শিবলিঙ্গ দেখা যায়। সেখানকার মন্দির জয়ন্তীর রাজা বানান । প্রথমে স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্থানীয় আদিবাসী মেয়েরা খড় বাঁশের মন্দির নির্মাণ করে ভগবান শিবের পূজা করতো। রাজা এখানে মন্দির নির্মাণ করেন । “অসমের ইতিহাসের” রচয়িতা জৈনেক ব্রিটিশ সাহেব তাঁর লেখনীতে জানিয়েছেন- জয়ন্তী পীঠ জয়ন্তীয়া পরগণার ফাজলপুরে অবস্থিত । এখানে দেবীর বাম চরণের নিম্নাংশ পড়েছিল ।
এমন শোনা যায় শ্রীহট্টের এই মন্দিরে জয়ন্তী রাজা শারদীয়া নবমীর দিন নরবলি দ্বারা মায়ের পূজো করতেন । ১৮৩২ সালে এই রাজ্যের শেষ রাজা রাজেন্দ্র সিংহ অসমের নঁগাও থেকে এক মানুষকে এনে নরবলি দিলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে খবর যায় । তৎকালীন বড়লাট এতে ক্রুদ্ধ হয়ে রাজ্য দখল করে জয়ন্তীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । সেই থেকে মন্দিরে নরবলি উঠে যায় । তবে ঘাট বলি ( পশু বলি) হয় । প্রথম পর্বে বলেছিলাম এই পীঠের অবস্থান নিয়ে ভিন্ন মত আছে । হাওড়ার আমতায় অনেকে এই পীঠ এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার সংলগ্ন ভূটান পাহারে এই পীঠ অবস্থিত বলে মানা হয় । ভারত পর্যটক ভূপতিরঞ্জণ দাস তাঁর রচনাতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে রাজাভাতখাওয়া জঙ্গলের কাছে ভূটান পর্বতে এই পীঠ বলে ধরেন । জ্ঞানার্ণব তন্ত্র ও বিশ্বসার তন্ত্রে এই স্থানের উল্লেখ আছে । রাজাভাতখাওয়া স্টেশনে নেমে ১৬ কিমি দূরে জয়ন্তী স্টেশন । সেখানে থেকে হাটা পথে মাইল পাঁচেক গেলে জয়ন্তী। পাশ দিয়ে একটি ছোট্ট নদী বয়ে গেছে । অরন্য এখানে নিবির । হাতী, হরিণ, বিষাক্ত সাপ এমনকি কপালে থাকলে মায়ের বাহন বাঘকেও দেখা যেতে পারে । এই পথ খুব দুর্গম । ভূটান বাসীদের কাছে সহজ। কারন তারা পাহার দিয়ে আসেন। ভূটানী রাই বেশী পূজো দেন এখানে ।
পাহাড়ে তিনটি গুহা । খুব সরু প্রবেশ পথ । এখানে অল্প পাহাড়ে উঠলে তিনটি গুহা দেখা যায় । একটি হল মহাকাল ভৈরবের গুহা। একটি জয়ন্তী রূপী মহাকালী মায়ের গুহা। অপর একটি গুহাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ দেখা যায় । এই মহাকালী হল একান্ন পীঠের দেবী জয়ন্তী । গুহাতে অনেক প্রাকৃতিক ভাবে নির্মিত লিঙ্গ দেখা যায় । পুরোহিত এখানে পূজা করে সন্ধ্যার আগে চলে যান । কারন এই স্থান খুব দুর্গম । যানবাহন খুব একটা নেই । পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ – সন্ধ্যার পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় । মহাকালীর গুহাতে প্রাকৃতিক ভাবে নির্মিত শিলাঝুরির মহাকালী বিগ্রহ দেখা যায় । ইদানীং ভারতীয় সাধু সন্ন্যাসী রা এখানে এসে যাগ যজ্ঞ পূজা করেন । কারন বাংলাদেশে যাবার ভিসা সহজে মেলে না। আর বাংলাদেশে হিন্দু দের উপর যে আক্রমণ ও উৎপাত শুরু হয়েছে তাতে সাধু সন্ন্যাসী গন ওখানে গিয়ে নিজেদের বাঁচাবেন নাকি মায়ের সাধনা করবেন । এমন কোনো দিন নেই যেদিন হিন্দু নির্যাতনের খবড় পাওয়া যায় না । তাই সাধু সন্ন্যাসী গন কিছু তন্ত্র সমর্থিত এই পশ্চিমবঙ্গের জয়ন্তী পীঠে এসে সাধনা করেন ।
জয়ন্তী শক্তিপীঠ এর অবস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ কেউ আবার পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় আমতায় এই পীঠ অবস্থিত বলে মনে করেন । এই মন্দির কে “মেলাইচণ্ডী” নামেও ডাকা হয় । ১৯৫০ সালে প্রকাশিত গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকাতে বলা হয়েছিল সতী দেবীর হাঁটুর মালাইচাকি পড়েছিল দামোদর নদীর অপর পাশে । মন্দিরের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম জয়ন্তী । এখানেই দেবীর বাঁ চরণের মালাই চাকি পতিত হয় । এই মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন তন্ত্র সাধক জটাধারী চক্রবর্তী । তাঁর নিবাস ছিল আমতা। আমতা থেকে তিনি রোজ নৌকোতে দামোদর নদ পার করে মন্দিরে এসে পূজো দিতেন । একদা এক আশ্চর্য কাণ্ড হয় । তখন বর্ষা কাল। মুসল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। দামোদরের জল উথাল পাথাল অবস্থা । পূজো তো বাদ দেওয়া যাবে না। সাধক জটাধারী সেই বৃষ্টিতেই চললেন। কিন্তু ভরা নদে উথাল পাথাল ঢেউ দেখে মাঝি নৌকা চালানোর সাহস পেলো না। কারন নৌকো ডুবে যাবে।
সাধক জটাধারী বিলাপ করতে লাগলেন। জটাধারী রোদোন করে বলতে লাগলেন- “মা আজ আর তোর পূজো করতে পারলাম না। আজ তোকে খেতে দিতেও পারবো না।” বলে জটাধারী মাটিতে মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলেন। অশ্রুজল, বৃষ্টির জলে মিশে তাঁর গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। হঠাত জটাধারী দেখলেন নদীতে একটি কুমীর ভেসে আসছে । জটাধারী কি ভেবে সেই কুমীরের পীঠে উঠে পড়লেন । কুমীর তাকে নদীর ঐপারে পৌছে দিলো। সাধক মনের আনন্দে মন্দিরে পৌছে মায়ের পূজো করলেন । এরপর থেকে প্রায় প্রায় সাধক কে ঐ কুমীর নদী পারাবার করে দিতো। জটাধারীর প্রয়াণের পর তাঁর বংশধর দের নদীর ঐপারে গিয়ে পূজো করা সম্ভব হয় নি। মা স্বপ্নে আদেশ করেন- আমতায় তেই পূজো করতে। সেই থেকে আমতায় পূজো হয়। আমতায় দেবীর একটি আটচালা মন্দির আছে। মন্দির টি নির্মাণ করেন কলকাতার হাটখোলা অঞ্চলের লবণ ব্যাবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত । একদা ব্যবসায়ী নৌকোতে প্রচুর জিনিষ নিয়ে ফিরছিলেন। এই স্থানে এসে তাঁর নৌকো সব ঝড়ে ডুবে যায়। কৃষ্ণচন্দ্র কোনোরকমে প্রানে বাঁচলেন। এই স্থানে দেবী স্বপ্নে তাঁকে আদেশ দিলেন- “আমি খুব কষ্টে আছি। তুই এখানে আমাকে একটা মন্দির বানিয়ে দে। তোর কল্যাণ হবে।” ব্যবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র সেই স্থানে দেবীর প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখতে পেলেন। তিনি সেই স্থানে দেবীর একটি মন্দির নির্মাণ করলেন । মায়ের কৃপায় ডুবে যাওয়া নৌকোগুলি আবার ভেসে উঠেছিল জিনিস পত্র, লোক লস্কর সমেত।
এখানে দেবীর মূর্তিতে সোনার চোখ, নাক, মুখ বসানো । তবে এখানে দেবীর ভৈরব ক্রমদীশ্বর নন। তিনি এখানে দুর্গেশ্বর নামে বিরাজ করছেন । তবে প্রাচীনত্ব ও শাস্ত্র বিধি অনুসারে শ্রীহট্টের পীঠকেই সঠিক দেবীপীঠ বলা যেতে পারে । একটা সময় বঙ্গপ্রদেশ তন্ত্র সাধনা ও শক্তিপীঠের সাধনার জন্য বিখ্যাত ছিল। উভয় বঙ্গে প্রচুর প্রাচীন কালী মন্দির, শক্তিপীঠ দেখা যায় । কত শত তন্ত্র সাধক জন্মেছেন উভয় বঙ্গে। যবন আক্রমণ ও বৈষ্ণব দের অত্যাধিক বাড়াবাড়িতে এই শক্তি সাধনা লুপ্ত হতে বসেছে । শক্তিহীন হলে যেমন মানুষ দুর্বল হয়ে যায়, তেমনি শক্তি সাধনার অভাবে হিন্দুরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে । তাই দেবীর কাছে প্রার্থনা জানাই- “হে আদ্যাশক্তি। তুমি মহাশক্তি রূপে শিরায় শিরায় শিরায় প্রবাহিত হও । তুমি শক্তিরূপে হৃদয়ে বিরাজিতা হও । তুমি দানবনাশিনী রুদ্রানী মহাকালী রূপে আমাদের অন্তরে জাগরিতা হও । জয় মা ।”
নিচের ছবিটি মা মেলাইচন্ডী পীঠের এবং ইনসেটে শ্রীহট্টের সতীপীঠে পূজিত শিলা রূপে মাতা জয়ন্তী।
ছবিটি দেখামাত্র অবশ্যই শেয়ার করুন এবং
সতীকথায়_সতীপীঠ এর পরবর্তী পর্বগুলো দেখতে
Kolkata Durga Puja Festival 👈 এই
পেজটিতে লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন।